অস্থির বাংলাদেশের গমের বাজারইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ ক্যালরি গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রায় ৬৮ শতাংশ চালের ওপর নির্ভর করে। যার প্রায় ৭ শতাংশ যোগান আসে গম থেকে। গমের চাহিদাও গত ২০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ট্রেড ডাটা মনিটরের ইউএসডিএ রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ চাহিদার ৮৭ শতাংশ গম আমদানি করে। এর অর্ধেক আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। এছাড়া বিশ্ববাজারে মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ গম সরবরাহ করে রাশিয়া।
যুদ্ধের কারণে দেশ দুটি থেকে এ পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় বাংলাদেশে গমের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। আটা-ময়দার পাশাপাশি বেকারি পণ্যের দামও হু হু করে বেড়েছে। যুদ্ধের আগে যে প্যাকেটজাত আটার দাম কেজিপ্রতি ছিল ৩২-৩৫ টাকা। সেটি এখন বেড়ে হয়েছে ৬৫-৬৮ টাকা। দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, ‘গমের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চালের দামও প্রতিবেশী যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বাজারে অনেক বেশি হারে বেড়েছে। এ দাম বাড়ার কারণ চালের সরবরাহ ঘাটতি নয়। ব্যবসায়ীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে বলেই আমার ধারণা। এদিকে খাবারের দাম বাড়লেও মানুষের আয় বাড়েনি। ফলে মানুষের জন্য জীবনধারণ ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।’
ঘোলাটে ভোজ্যতেলের বাজারযুদ্ধের প্রভাবে নাস্তানাবুদ বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের বাজারও। বিশ্বে সূর্যমুখী তেলের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই ইউক্রেন ও রাশিয়া সরবরাহ করে। বাংলাদেশে সূর্যমুখী তেল তেমন আমদানি না হলেও যুদ্ধ অন্য সব ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
বাংলাদেশে ভোজ্যতেল হিসেবে মূলত পাম অয়েল ও সয়াবিন তেল ব্যবহার হয়। যেগুলো আমদানি করা হয় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে। বাংলাদেশ এসব ভোজ্যতেলের প্রায় সবটাই কাঁচা তেলবীজ আকারে আমদানি করে, যা অভ্যন্তরীণভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিটিউটের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে অল্প পরিমাণে তেলের বীজ কেনে। সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত সয়াবিন কেনে আর্জেন্টিনা থেকে। আর সয়াবিনের বীজ কেনে ব্রাজিল থেকে। যুদ্ধের ফলে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে পাম অয়েল ও সয়াবিন তেলের চাহিদা এবং দাম দুটোই অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়।
পাম অয়েলের সবচেয়ে বড় উৎপাদক ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে পড়ে। অথচ বাংলাদেশে বছরে ২০ লাখ টনের মতো ভোজ্যতেল লাগে। এর মধ্যে বাংলাদেশে উৎপাদন হয় দুই থেকে তিন লাখ টন। বাকি পুরোটাই অর্থাৎ চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করতে হয় আমদানি করে। ফলে বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যায়। এর ওপর ভোজ্যতেল রপ্তানিকারকদের আরোপিত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাও পণ্য সংকটের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
যুদ্ধের বাজারে কমেছে আমিষ খাওয়াবাংলাদেশে আমিষের একটি বড় চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে ফার্মের মুরগি থেকে। এ মুরগির দামও এখন নাগালের বাইরে। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা মুরগির খাবারের দাম বেড়ে যাওয়াকে দুষছেন। বাংলাদেশে পোলট্রি ফিড উৎপাদনের ৬০ শতাংশ উপকরণ আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে ভুট্টা। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ১৬ শথাংশ ভুট্টা সরবরাহ করে। এরমধ্যে বাংলাদেশও চাহিদার বড় অংশ আমদানি করে ইউক্রেন থেকেই।
যুদ্ধের কারণে যেহেতু ইউক্রেন থেকে ভুট্টা সরবরাহ আসতে পারছে না, সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও পোলট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে মুরগি ও ডিমের দামের ওপর। এতে নিম্নবিত্তদের আহারে লাগাম পড়েছে বলে জানান খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, ‘খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় মানুষ আমিষ খাওয়া থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে। পুষ্টিমানকে জলাঞ্জলি দিয়ে ন্যূনতম খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। সরকারকে এজন্য যে করেই হোক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’
সার সঙ্কটে ঝুঁকিতে কৃষিবাংলাদেশের কৃষি, বিশেষ করে ধান উৎপাদন ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল। এসব সারের একটি বড় অংশ রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে আমদানি করা হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসিচ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বছরে প্রতি হেক্টর ফসল চাষে গড় ২৮৬ কেজি সার ব্যবহার করতে হয়। যার বড় অংশজুড়েই থাকে পটাশ সার। বাংলাদেশ এ পটাশ সারের চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশ বা ১২ লাখ টনের বেশি সার রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে আমদানি করা হয়। আবার অভ্যন্তরীণ কয়েকটি কারখানায় যে সার উৎপাদন হয়, সেটির উৎপাদনও জ্বালানি সংকটের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।